Type the name of a full movie

Get

সমুদ্রতলে ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ


আগুর পাখি বলে মানেন অনেকে। পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন মাত্র ৩৯ বছর। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তার মতো আলোড়ন আর কজন তুলতে পেরেছে? সে হিসাব কষলে, তিনি একাই ইতিহাস কাঁপিয়েছেন। তিনি ক্লিওপেট্রা। যার নামের সঙ্গে মিশে আছে সৌন্দর্য, মোহনীয়তা, ক্ষমতা আর প্রচণ্ড উচ্চাভিলাষ। প্রাচীন মিসরের নাম যারা জানেন তাদের কাছে ক্লিওপেট্রা অবিসংবাদিত। সর্বকালের সেরা ক্ষমতাবান নারীর তালিকায় তাকে উপরের দিকে রাখলে কি ভুল হবে? ক্লিওপেট্রার রূপ লাবণ্যের গল্প বারবার উচ্চারিত হয়েছে। তবে মিসর কাঁপানোর ক্ষমতা যার মুঠোবন্দী ছিল তাকে নিয়ে কৌতূহল অন্য উচ্চতার। যেটা যুগে যুগে উপলব্ধি করেছে মানুষ। ইতিহাসবেত্তা থেকে শুরু করে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ফিরে ফিরে তাকে ঘিরে লিখেছেন হাজার হাজার পৃষ্ঠা। মঞ্চে উঠেছে তার ট্র্যাজেডি। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্র’, জর্জ বার্নাড শর ‘সিজার ক্লিওপেট্রা’, জন ড্রাইডেনের ‘অল ফর লাভ’, হেনরি হ্যাগার্ডের ‘ক্লিওপেট্রা’। মিসরের রানী ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে বহু মিথ ছড়িয়ে আছে মানুষের মনে, বইয়ে। শুধু তার সময়েই নয়, এখনো ইতিহাস কাঁপানো এ কিংবদন্তী নারী বহু পুরুষের কাছে আকাঙ্ক্ষিত। মিসরের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহর আলেকজান্দ্রিয়ায় ছিল তার একক আধিপত্য। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ অব্দ।


মিসর জয় করেন বীর আলেকজান্দার। সেই জয়ের স্মারক হিসেবে নতুন এক নগরী স্থাপন করেন তিনি। সে নগরের নাম রাখা হয় আলেকজান্দ্রিয়া। এরপর থেকে মিসর শাসন করে গ্রিসের টলেমাইক বংশ। ক্লিওপেট্রা এই বংশের কন্যা ছিলেন। প্রথমে বাবা ইরিয়াক-২ এর সঙ্গে পরে একাই ফারাও হিসেবে বসেন মিসরের সিংহাসনে। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত নারী শাসক ক্লিওপেট্রা সপ্তম হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন মেসিডোনিয়ান বংশোদ্ভূত সপ্তম মিসরীয় রানী। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৫১ অব্দে রোম সম্রাট টলেমি অলেতিস মারা যান। এই বিশাল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার কে হবেন সে নিয়ে চারদিকে আলোচনা শুরু হয়। অবশেষে তিনি বেছে নেন ক্লিওপেট্রা ও তার পুত্র টলেমিকে। ক্লিওপেট্রার বয়স তখন সবে ১৮ বছর। অলেতিস পুরো সাম্রাজ্য উইল করেন টলোম ও ক্লিওপেট্রাকে। অবশ্য মৃতুর সময় এও বলে যান এই বিশাল সাম্রাজ্য রোমান নেতা পম্পেও দেখাশোনা করবেন। শুধু রাজ্য নয় তার সন্তানদের দেখাশোনা করার দায়িত্বও তার হাতে দিয়ে যান। সমস্যা দেখা দিল অন্যখানে। সে সময় যে মিসরীয় আইন তাতে দ্বৈত শাসনের কিছুটা বাধ্যবাধকতা ছিল রানী ক্লিওপেট্রার জন্য। নিয়ম অনুযায়ী রানী ক্লিওপেট্রার একজন নিজস্ব সঙ্গী থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। যে কারণে ক্লিওপেট্রার কাছে বিয়ে ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। রাজরক্ত রক্ষায় ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করতে হয় তারই ছোটভাই টলেমিকে। টলেমির বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। এই বিয়ের ফলে আর আইনি বাধা রইল না। পুরো রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বভার ক্লিওপেট্রার হাতে এসে গেল। ক্লিওপেট্রা এবং তার স্বামী ১২ বছর বয়সী ছোট ভাই টলেমি মিসরের দায়িত্ব নেন। এটা বলা বাহুল্য, আদতে ক্লিওপেট্রাই সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। ক্লিওপেট্রার রাজ্য শাসন নিয়ে স্পষ্ট করে অনেক কিছুই জানা সম্ভব হয়নি। তবে তার রাজ্যের ওপর নানা ঝড়-ঝাপটা আসতে শুরু করে। সাহসীকতা ও বুদ্ধিমত্তার জোরে ক্লিওপেট্রা যেভাবে মিসরকে আগলে রাখতে চাইছিলেন তা যথেষ্ট ছিল না। তবু ক্ষমতায় আরোহণের পর নানা প্রতিকূলতায় ক্লিওপেট্রা তার শাসন চালিয়ে যান। তার রাজ্যে সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। ফারসালুসের যুদ্ধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাপতি পম্পে পরাজিত হন। সে বছরই আলেকজান্দ্রিয়ায় ফেরার পথে ফারসালুসের হাতে নিহত হন। যুদ্ধ থেকে পালাতে গিয়ে ক্লিওপেট্রার স্বামী ও ভাই টলেমি মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যুর পর ক্লিওপেট্রা হয়ে ওঠেন মিসরের একমাত্র রানী। পুরো রাজ্যভার এখন তার হাতে। ক্ষমতার পুরো পেয়ালা তার হাতে উঠে আসার পর ক্লিওপেট্রার মিসরের দেখা মেলে। 


ক্লিওপেট্রার জীবনে আসতে থাকে নানা গল্প। শুরুতেই আবির্ভাব ঘটল রোমের পরাক্রমশালী বীর মার্ক অ্যান্টনির। ক্লিওপেট্রার বুদ্ধিমত্তা আর সৌন্দর্যের কথা তখন রাজ্য থেকে রাজ্যে ছড়িয়ে গেছে। লোকমুখে সে কথা অ্যান্টনির কানেও পৌঁছেছিল। অ্যান্টনি চাইলেন যে কোনোভাবেই হোক ক্লিওপেট্রার সঙ্গে দেখা করবেন। রোম থেকে অ্যান্টনি এলেন ক্লিওপেট্রার রাজকীয় প্রাসাদে। এ মিথ কে না জানে, প্রথম দেখাতেই ক্লিওপেট্রার মন জিতে নেন অ্যান্টনি। অবশ্য কারও কারও মতে মিসর আক্রমণ করতে এসে ক্লিওপেট্রার প্রেমে পড়ে যান রোমান বীর অ্যান্টনি। সে যাই হোক, প্রেমের আগুনে তখন পুড়ছেন দুজনেই। এদিকে হিসাব বেশ পাল্টে গেছে। ক্লিওপেট্রা শুধু প্রেমই পেলেন না, সঙ্গে মুফতে পেয়েছেন সিংহাসন রক্ষায় এক পরাক্রমশালী বীরের সমর্থন। অ্যান্টনি কিন্তু বিবাহিত ছিলেন। তার পত্নী ফুলভিয়ার মৃত্যু এবং পম্পের বিদ্রোহ এলোমেলো করে দেয় তাদের। রোমে তখন গৃহযুদ্ধের দাবদাহ। এরপর গল্পে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়। ক্লিওপেট্রার জীবনে আবির্ভাব ঘটে মধ্যবয়সী বীর জুলিয়াস সিজারের। এলোমেলো মুহূর্তে সিজারকেও আঁকড়ে ধরেছিলেন ক্লিওপেট্রা। তবে তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। রাজাদের জীবনের দুঃসময় সব শেষ করে দিয়ে যায়। একসময় অসহায় অ্যান্টনি আত্মহত্যা করেন। ক্লিওপেট্রাও মৃত্যুকে বেছে নেন। ঐতিহাসিকদের মতে ক্লিওপেট্রা বিষধর সাপের দংশন খেয়ে আত্মহত্যা করেন। তার মৃত্যুর পর ফারাও হন তার ছেলে সিজারিয়ান। কিন্তু তাকে হত্যা করে মিসরের শাসনভার নেন জুলিয়াস সিজার অক্টাভিয়ানাস। মিসরে শুরু হয় রোমান শাসন। ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে সেই কৌতূহলের শেষ নেই আজও। এখনো আগ্রহীরা খোঁজ করেন তার চিহ্নটুকু। ক্লিওপেট্রা এবং তার শাসন পদ্ধতি সবই যেন রহস্যময়। ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ এবং সাম্রাজ্যের বড় অংশ এখন ঘুমিয়ে আছে ভূমধ্যসাগরের নিচে। গ্রিক ঐতিহাসিক স্ত্রাবোর লেখায় জানা যায় ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ ছিল মিসরের অ্যান্তিরহোদোস দ্বীপে। এই দ্বীপের অস্তিত্ব বহুদিন আধুনিক পৃথিবী জানতে পারেনি। শেষতক জানা গেল, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প এবং সুনামিতে ক্লিওপেট্রার প্রাসাদসহ এই দ্বীপটিকে গ্রাস করে নিয়েছে ভূমধ্যসাগর। আলেকজান্দ্রিয়া শহরের উপকূলেই ছিল এই দ্বীপ। প্রায় এক হাজার ছয়শ বছর আগে ভূমিকম্প ও সুনামিতে তলিয়ে যায় আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত বাতিঘরও।


মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ার একদল ডুবুরি হঠাৎ করেই পেয়ে যান ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ ও দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। এই ডুবুরি দলের নেতৃত্বে ছিলেন ফ্রান্সের প্রত্নতত্ত্ববিদ ফ্র্যাঙ্ক গর্ডিও। ১৯৯০ থেকে তারা সাগর চষে বেড়ান শুধু ক্লিওপেট্রার হারিয়ে যাওয়া সাম্রাজ্যের খোঁজে। ১৯৯১ সালের ২৩ জানুয়ারি ভূমধ্যসাগরের গভীরে পাওয়া যায় ক্লিওপেট্রার প্রাসাদের অস্তিত্ব। কার্বন ডেটিং পরীক্ষা করে বলা হলো, এই প্রাসাদ তৈরি হয়েছিল রানীর জন্মেরও ৩০০ বছর আগে। দেখা গেল পানির অতলে ঘুমিয়ে আছে প্রাচীন নগরী, লাল রঙের মিসরীয় গ্র্যানাইটে তৈরি দেবী আইসিসের মূর্তি ক্লিওপেট্রার পরিবারের সদস্যদের মূর্তি প্রচুর অলঙ্কার বাসনপত্র এবং স্ফিংক্সের দুটি মূর্তি। রয়েছে সে সময়ের মুদ্রা থেকে শাসকদের মূর্তি। ডুবুরিরা তুলেও এনেছেন মিসরের শেষ রানী ক্লিওপেট্রার রাজ্যের অনেক মূর্তি, মুদ্রা ইত্যাদি। প্রত্নতত্ত্ববিদ গর্ডিও ও তার দল ক্লিওপেট্রা এবং তার প্রেমিক জুলিয়াস সিজারের ছেলে সিজারিয়ানের মাথার পাথরের মুকুট উদ্ধার করে। সাগরের নিচে প্রায় এক হাজার ৪০০ বছরের বালি আর কাদা মাখা ইতিহাসের অমূল্য এই দলিলের বেশ কিছু নিদর্শন তুলে আনা হয়েছে জনসমক্ষে। কিন্তু প্রতিকূলতার জন্য বেশির ভাগই রয়ে গেছে পানির নিচে।