Type the name of a full movie

Get

নাসার মঙ্গলযাত্রা

২০১৫ সালের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র দ্য মার্শিয়ান-এ দেখা যায়, মঙ্গল গ্রহে আটকে পড়া এক মহাকাশচারীকে বীরের মতো উদ্ধার করছে নাসা। মিশনের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের কাছ থেকে তেমন সহায়তা না পেয়ে ওই মহাকাশচারীকে টিকে থাকার ক্ষেত্রে বিপুল বুদ্ধির স্বাক্ষর রাখতে হয়েছিল। রিডলি স্কটের পরিচালনায় বানানো ছবিটি দৃষ্টিনন্দন, একটা টানটান বিনোদন উপহার দেয় সেটা। তবে অনেকের চিন্তার একত্র সমাবেশ ঘটাতে পারলে মানুষের পক্ষে কত দূর কী অর্জন করা সম্ভব, সেটাও তুলে ধরেছে এ ছবি। স্ট্যানলি কুব্রিকের ১৯৬৮ সালের মাস্টারপিস ২০০১: আ স্পেস অডিসি-এর মতো এটিও ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানের চেহারাটা কেমন দাঁড়াবে, তার একটা ঝলক উপহার দেয়।
চলচ্চিত্রটি তৈরি হওয়ার সময় কিছু কারিগরি পথনির্দেশ দিয়েছে নাসা। অত্যাধুনিক মহাকাশ-পোশাক থেকে শুরু করে মহাকাশে খাদ্য উৎপাদনের পদ্ধতি পর্যন্ত এমন কিছু প্রযুক্তি অনেক দৃশ্যে তুলে ধরা হয়েছে, যেগুলো নিয়ে আমরা আসলেই এখন কাজ করছি। ভবিষ্যতে কোনো দিন সত্যিকার মঙ্গল অভিযানেও এই প্রযুক্তিগুলোই ব্যবহৃত হতে পারে।
২০৩০-এর দশকের মাঝামাঝি মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ঠিক করেছে নাসা। ‘নাসার মঙ্গলযাত্রা: মহাকাশ অভিযানের পরবর্তী পথিকৃৎ পদক্ষেপ’ শিরোনামে সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে আমরা একটা রূপরেখা দিয়েছি, যাতে বলা হয়েছে ওখানে যাওয়ার পথে মানবজাতির করণীয় কী কী। এসব পদক্ষেপের মধ্যে আছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) অব্যাহত গবেষণা, এবং তারপর নিম্ন পার্থিব কক্ষপথ থেকে মানুষকে সেই অঞ্চলটিতে নেওয়া, যেটাকে আমরা বলি ‘পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্র’—এটা চাঁদের নিকটবর্তী মহাকাশ অঞ্চল। এটা করতে পারলে আমরা আমাদের সামর্থ্যের সীমারেখাকে এমন একটা অঞ্চল পর্যন্ত বাড়িয়ে নিতে পারব, যেখান থেকে মহাকাশচারীরা অল্প কিছুদিনের মধ্যে নিরাপদে ফিরে আসতে পারেন।
দ্য মার্শিয়ান চলচ্চিত্র একটা জায়গায় ভুল করেছে। ওখানে যেমনটা দেখানো হয়েছে, মঙ্গল গ্রহে মনুষ্য অভিযান কিন্তু সে রকম নাসার প্রাধান্যবিশিষ্ট একটা উদ্যোগ হবে না, যেমনটা ঘটেছে চাঁদের পিঠে নাসার সত্যিকার অভিযানের বেলায়। বরং মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর প্রস্তুতিতে সারা পৃথিবীর মানুষ আর সম্পদ ভূমিকা রাখবে এবং অভিযাত্রাটি অন্যান্য দেশের মহাকাশ সংস্থার সঙ্গে অংশীদারি ভিত্তিতে পরিচালিত হবে, ব্যক্তি খাতেরও সহায়তা নেওয়া হবে।
মহাকাশ ও সৌরজগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের চৌহদ্দি বাড়ানোর জন্য এরই মধ্যে সারা বিশ্বের সংস্থাগুলো একত্রে কাজ করতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন নির্মাণ এবং সেটা পরিচালনার পেছনে ১৫টি দেশের হাজার হাজার লোক নিযুক্ত। সৌরজগতে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পাশাপাশি মহাকাশে দীর্ঘকাল অবস্থানের সময় কী করে মানুষকে সুস্থ রাখা যাবে, তার হাড়ের ঘনত্ব ক্ষয়ে যাওয়া আর পেশি শিথিল হয়ে যাওয়া কী করে কমানো যাবে—এসব বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যৌথভাবে অজস্র মহাকাশযান পাঠিয়ে রোবোটিকভাবে মঙ্গল গ্রহে অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে নাসা। নাসার মার্স সায়েন্স ল্যাবরেটরি কিউরিওসিটি রোভারে নানা রকম যন্ত্রপাতি জোগান দিয়েছে পাঁচটি দেশ। এর মধ্যে স্পেনের সেন্ত্রো দি আস্ত্রোবায়োলজিয়ার নির্মাণ করা একটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ স্টেশনও আছে। এসব প্রচেষ্টার বরাতে মঙ্গল গ্রহের আবহাওয়া সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা পাওয়া যাবে, যা সেখানে মানুষের সশরীরে পদার্পণের ক্ষেত্রে ঝুঁকি কমাবে। তা ছাড়া সেখানে ভবিষ্যৎ অভিযানে কী কী সম্পদ পাওয়া যাবে না যাবে, সে সম্পর্কেও একটা ধারণা পাওয়া যাবে। নাসার ওরিয়ন মহাকাশযানের জন্য ইউরোপিয়ান মহাকাশ সংস্থা একটা সার্ভিস মডিউল বানিয়ে দিচ্ছে। এই ওরিয়ন মহাকাশযান অ্যাপোলো কর্মসূচির পর প্রথমবারের মতো চাঁদের ওপারে মহাকাশচারী বহন করে নিয়ে যাবে।
ব্যক্তি খাতের কোম্পানিগুলোও তাদের পক্ষে যা করা সম্ভব করছে। নাসার বাণিজ্যিক পরিবহন কর্মসূচির আওতায় এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে রসদ বয়ে নিয়ে গেছে স্পেসএক্স এবং অরবিটাল এটিকে। এ ছাড়া ২০১৮ সাল থেকে মহাকাশচারী বয়ে নিয়ে যাওয়া শুরুর পরিকল্পনা করছে বোয়িং ও স্পেসএক্স। মহাকাশ স্টেশনে ব্যক্তিমালিকানাধীন বিভিন্ন কোম্পানির নতুন নতুন প্রযুক্তির পরীক্ষা চালাচ্ছি আমরা, যেমন ত্রিমাত্রিক প্রিন্টার, যা মহাকাশযাত্রাকে আরও টেকসই করে তুলবে।
শুধু নিজেদের সামর্থ্য দেখানোর জন্যই যে আমরা মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছি এমন নয়। আমরা এটা করছি, কারণ ওই গ্রহ সম্পর্কে আমরা যা কিছু জানব, তা পৃথিবীর বুকে প্রাণ সম্পর্কেই আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করবে।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বিশ্বাস করি, পৃথিবীর বাইরে প্রাণের সাক্ষ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে মঙ্গল গ্রহই সবচেয়ে সম্ভাব্য স্থান। প্রাণের জন্য সবচেয়ে জরুরি শর্ত যে পানি, সেটা মঙ্গল গ্রহে প্রায় ১০০ কোটি বছর ধরে স্থিতিশীল দশায় ছিল। পৃথিবীতে বিবর্তন সম্পর্কে আমরা যেটুকু জানি, তার ভিত্তিতে বলা যায়, মঙ্গল গ্রহেও প্রাণের উন্মেষ ঘটে থাকতে পারে।
যা-ই হোক, মঙ্গল গ্রহে প্রাণের উদ্ভব যদি ঘটেও থাকে, সেটা যেহেতু অণুজীব স্তরের বেশি বিবর্তিত হতে পারেনি, কাজেই প্রাণের সাক্ষ্য অনুসন্ধানের জন্য আমাদের সেখানে মহাকাশজীববিজ্ঞানী আর ভূ-প্রকৃতিবিজ্ঞানী পাঠাতে হতে পারে। ওই গ্রহের পৃষ্ঠদেশে তরল পানির অস্তিত্বের সাম্প্রতিক সাক্ষ্যের পর বিজ্ঞানীরা এখন এই সম্ভাবনাও ভেবে দেখছেন যে ওপরের পৃষ্ঠদেশের পরিস্থিতি বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাওয়ার ফলে মঙ্গল গ্রহে মাটির অভ্যন্তরে ঠাঁই নিয়ে প্রাণ এখনো নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে কি না।
অবিমিশ্র বৈজ্ঞানিক বিষয়ের বাইরে মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার অন্য কিছু কারণও আছে। ওখানে মানুষ পাঠানো এমন এক চ্যালেঞ্জ, যেটা নতুন নতুন উদ্ভাবনকে উসকে দেবে, নতুন প্রযুক্তি আর সক্ষমতার উদ্ভব ঘটবে। হিসাব কষে দেখা গেছে, নাসার পেছনে ব্যয় করা প্রত্যেক ডলার আমেরিকার অর্থনীতিতে চার ডলার যোগ করে। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি একদা বলেছিলেন, আমরা মানুষকে চাঁদে পাঠাচ্ছি শুধু এ জন্য না যে, ‘এটা সহজ, বরং এ জন্য যে এটা কঠিন, কেননা এই লক্ষ্য আমাদের বল আর দক্ষতাকে পুনর্গঠন করতে আর পরিমাপ করতে সহায়তা করে।’
এসব প্রচেষ্টা পৃথিবীতে মানুষের সত্যিকার উপকারে লাগে। মহাকাশের জন্য উদ্ভাবন করা সাম্প্রতিক অনেক প্রযুক্তিই পৃথিবীতে ব্যবহারিক কাজে লাগানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের জন্য বানানো পানি বিশুদ্ধকরণব্যবস্থা পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে সাহায্য করছে। নাসার নতুন মহাকাশ উৎক্ষেপণব্যবস্থা আর ওরিয়ন ক্যাপসুল দ্রুতগতিতে ব্যাটারি চার্জ করার প্রযুক্তি সম্ভব করেছে। তা ছাড়া এগুলোর বরাতে আমরা আরও অগ্রসর নির্মাণ প্রযুক্তি আর হালকা উড়োজাহাজ কাঠামো পেয়েছি।
দ্য মার্শিয়ান ছবিতে অদম্য মহাকাশচারী মার্ক ওয়াটনি যেভাবে মঙ্গল গ্রহে অনুসন্ধান চালিয়েছেন, নাসাও ও রকম এক নতুন উচ্চতায় ওঠা এবং লোহিত গ্রহের রহস্য উদ্ঘাটনে একটি আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় অব্যাহতভাবে নেতৃত্ব দিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আর তা করতে গিয়ে আমরা সায়েন্স ফিকশনকে সায়েন্স ফ্যাক্টে পরিণত করব।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
এলেন আর স্টোফান: নাসার প্রধান বিজ্ঞানী